বয়কটেই কি মোক্ষলাভ ?

বেশ কয়েক বছর ধরেই চীনা দ্রব্যের বয়কটের দাবীতে সামাজিক মাধ্যম বেশ সরগরম।  কিন্তু তাতে যে মানুষ খুব একটা সাড়া দিয়েছে এমন নয়।  কিন্তু সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্যে চীন কে দায়ী করার আবহ, এবং তার সাথে ভারত-চীন সীমান্তে দুই দেশের সৈন্য সমাবেশ, এই বিষয়টাকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। কয়েকদিন থেকে সোনম ওয়াংচুক এর একটা ভিডিও বার্তা খুব দ্রুত গতিতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়াংচুক নিঃসন্দেহে একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। শিক্ষা এবং পরিবেশ নিয়ে তাঁর কাজকর্ম ভূয়সী প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু চীনা দ্রব্য বয়কটের ডাক যে তিনি দিয়েছেন সেটা নিয়ে তিনি যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছেন তো ? তবে সবার আগে মনে রাখা দরকার চীন সারা পৃথিবীতে যা রপ্তানি করে তার মাত্র ৩.৫ শতাংশ ভারতে আসে। তাই চীনা দ্রব্য বয়কটের মাধ্যমে আমরা চীনের কতটা ক্ষতিসাধন করতে পারবো সেবিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে গত কয়েক বছরে যে ভাবে ভারতের বাজারে চীনা দ্রব্য ঢুকে পড়েছে তাতে ভারতের অর্থনীতি বেশ বিপর্যস্ত। বাজারে গেলে কিছু খাবার দাবারের জিনিস ছাড়া ভারতীয় দ্রব্য পাওয়া বেশ দুস্কর। কিন্তু এর জন্য কি শুধু চীন কে দোষ দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় ?  এটা তো একদিনে হয় নি।  গত বিশ বছর ধরে এটা আস্তে আস্তে হয়েছে।  এতদিন ধরে আমরা কি করছিলাম ? আমাদের সরকার এবং শিল্পপতিরা কি করছিলো ? আর বয়কট করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? হঠাৎ করে রাতারাতি আমাদের দেশে সবকিছুর উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে ?

তবে বয়কটের ধারণা আমাদের দেশে এই প্রথম নয়।  ব্রিটিশ শাসনের সময়ও ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছিল।  বিশেষ করে বাংলায় বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ বস্ত্র বর্জন করার ডাক বেশ তীব্র হয়েছিল।  সেই সময় অবশ্য একটা সঙ্গত কারণ ও ছিল। দেশে তখন ব্রিটিশ সরকার, যার ফলে আমরা বাণিজ্য নীতি ঠিক করতে পারছিলাম না।  আর ব্রিটিশ রা একমুখী মুক্ত বাণিজ্য নীতি চালু করে আমাদের দেশের শিল্পকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো।  অর্থাৎ যত সহজে ব্রিটিশ দ্রব্য কোন রকম শুল্ক না দিয়ে ভারতের বাজারে ঢুকতে পারতো তত সহজে কিন্তু ভারতীয় দ্রব্য ব্রিটিশ বাজারে ঢুকতে পারতো না।  শিল্পের প্রয়োজনের কাঁচামালের জন্য অবশ্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। এতদ সত্বেও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পারেন নি স্বদেশী আন্দোলন কে সমর্থন করতে।  ঘরে বাইরে তো আমরা সবাই পড়েছি বা দেখেছি।  স্বদেশী আন্দোলনের মধ্যে একদিকে যেমন তিনি দেখেছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে গরিব মানুষের প্রয়োজনের প্রতি চরম উদাসীনতা বা অসংবেদনশীলতা। অনেক ছোট ছোট কাপড়ের ব্যবসায়ীর সংগ্রহের সমস্ত বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ের পুরো মূলধনটাই হারিয়ে অনেক ছোট ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছিল।

আজকের পরিস্থিতি তো আলাদা।  আমাদের দেশের বাণিজ্যনীতি আমাদের হাতেই।  সরকার চাইলেই অন্তত তার বাণিজ্যনীতি দিয়ে চীনা দ্রব্যের আমদানি কিছুটা হলেও কম করতে পারতো।  কিন্তু সেরকম কিছু আমরা করিনি।  কিন্তু আজকের বয়কটের ডাক স্বদেশী আন্দোলনের থেকেও অনেক বেশি বিপদ নিয়ে আস্তে পারে।  বড় আমদানিকারী সংস্থা থেকে পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতা প্রত্যেকের সংগ্রহের একটা বড় অংশই চীনা দ্রব্য। অর্থাৎ এদের মূলধনের একটা বড় অংশই চীনা দ্রব্যের আকারে গচ্ছিত আছে। আবার এই মূলধনের একটা বড় অংশই হল ব্যাংকের লোন।  গত দু মাসের ও বেশি সময় ধরে লকডাউনের ফলে এই ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই, বিশেষ করে খুচরা ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সমস্যার মধ্যে আছে।  আজকে যদি আমরা সত্যি সত্যিই এগুলো বয়কট করি তাহলে তো এদের বেশিরভাগ মূলধনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।  আর স্বদেশী আন্দোলনের সময়েও যেটা হয়েছিল, এদের অনেকের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া চীনা দ্রব্য বয়কট হলেই সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ভারতীয় দ্রব্য উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে তা তো নয়। আমরা বেশি দামে অন্যান্য দেশের জিনিস পত্র কিনতে বাধ্য হব। যার ফলে ডলারের হিসাবে আমাদের দেশের আমদানির পরিমান বেড়ে যাবে। বাড়বে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমান।  টাকার দাম কমে যাবে এবং আমাদের আর্থিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। অনেক জিনিসই হয়তো গরিব লোকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর গরিব লোকেরা বর্তমানে কেমন অবস্থায় আছে সেটাও আমাদের না জানা নয়।

তবে এ প্রসঙ্গে মোক্ষম জবাবটা কিন্তু দিয়েছিলেন সেই সময়ের মতুয়া সমাজের নেতা গুরুচাঁদ ঠাকুর। স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন এই দাবি নিয়ে, যাতে তিনি মতুয়া সমাজ তথা নমঃশূদ্র মানুষদের বোঝান বিদেশী দ্বস্ত্র বর্জন করতে।  নমঃশূদ্র মানুষদের বেশিরভাগই ছিলেন অত্যন্ত গরিব।  স্বভাবতই তাঁরা সস্তার বিদেশী কাপড় ই ব্যবহার করতেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁদের বলেছিলেন, নমঃশূদ্ররা তো বেশির ভাগ অর্ধনগ্নই থাকে, তবে বিদেশী কাপড় তাঁরা পড়েন বৃটিশ দ্রব্যকে ভালোবেসে নয়, অভাবের তাড়নায়।  কিন্তু আপনাদের তো অনেকের বিদেশী মদ, সিগার আর চুরুট না হলে চলে না।  বিদেশী স্যুট বুট পরে পার্টি করেন।  আর বাড়িতে আসবাবপত্র থেকে ঘর সাজানোর জিনিসপত্র সবই বিদেশী, সেসব কথা না বলে শুধু বিদেশী কাপড়ের পিছনে পড়েছেন, সেসব কি অর্ধনগ্নদের পূর্ণনগ্ন করার বাসনায় ? কে বলতে পারে আজকের চীনা দ্রব্য বয়কটের দাবীর ভারটাও গরীবদেরই বহন করতে হবে না ?

চীনা দ্রব্যের আগ্রাসন থেকে ভারতীয় শিল্প তথা অর্থব্যবস্থাকে বাঁচানোর দায়টা সরকারকেই নিতে হবে, যথোপযুক্ত বাণিজ্যনীতি, শিল্পনীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতি তথা কর্মসূচির মাধ্যমে।  চীন যেভাবে উৎকৃষ্ট পরিকাঠামো তথা সস্তায় বিদ্যুৎ, ব্যাঙ্ক লোন ও অন্যান্য পরিষেবার ব্যবস্থা করেছে সেটা হয়তো আমাদের পক্ষে এখনই বন্দোবস্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে।  কিন্তু সেটার মোকাবিলা কিভাবে করতে হবে তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং কৌশলী অর্থনৈতিক অভিমুখ দরকার। তবে বর্তমান শিল্প তথা প্রযুক্তিগত পরিস্থিতিকেও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

বর্তমানে অনেক শতাব্দী প্রাচীন নামি ভারতীয় কোম্পানিও চীনে প্রস্তুত হওয়া জিনিসপত্র আমদানি করে তাদের নিজেদের ব্রান্ডনামে বিক্রি করে।  কেউ কেউ অবশ্য ভারতে বানালেও পুরো যন্ত্রাংশ গুলোই নিয়ে আসে বিদেশ থেকে।  আবার অনেক বিদেশী কোম্পানি আছে যারা হয়ত তাদের সমস্ত জিনিসই ভারতে তৈরি করে।  মানুষ কাদের দ্রব্যকে বয়কট করবে ? সমস্ত তথ্য তো সাধারণ মানুষের কাছে নেই।  ভুল করে এমন কিছু করে বসবে তাতে লাভের থেকে ক্ষতি হবে অনেক বেশি।  তুলনায় সরকারের কাছে আছে অনেক বেশি তথ্য।  সেই হিসাবে সরকার তার আমদানি, রপ্তানি এবং শিল্প নীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে অনেক কিছু করতে পারে।

এটা ঠিক যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের কারণে শুধুমাত্র চীনা দ্রব্যের উপর আলাদা করে বেশী আমদানি শুল্ক আরোপ করা সম্ভব নয়।  সেক্ষেত্রে যদি কোন দ্রব্যের উপর বেশি করে শুল্ক চাপাতে হয় তাহলে সেটা সমস্ত দেশ থেকে আসা দ্রব্যের উপরেই চাপাতে হবে।  তাই এই নিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।  তবে আমদানি শুল্কই কিন্তু একটা সরকারের হাতে একমাত্র অস্ত্র নয়।  বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থব্যবস্থায় জোয়ার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অনেকেই এখন সরকারি খরচ বাড়ানোর দিকে জোর দিতে বলছেন । করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় অনেক কিছুই সরকার কিনতে বাধ্য হয়েছে এবং তার বেশির ভাগই আবার এসেছে বিদেশ, এমন কি চীন থেকেও।  এমন কি দেশে তৈরী হলেও কাঁচামাল এসেছে চীন থেকে।  অবশ্যই মহামারীর সময় মানুষ বাছবিচার করার জায়গায় থাকে না।  কিন্তু এখন যদি সরকারি খরচে অনেক কিছু করা যায় তাহলে তার জন্য যে সব দ্রব্যের প্রয়োজন হবে সেগুলো তা দেশ থেকে কেনার কথা ভাবাই যায়।  তার জন্য কোন বৈদেশিক চুক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এমনিতেই খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি।  তাই আমাদের পা ফেলতে হবে সাবধানে। মানুষ নিজেদের  মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ হবে না। তবে মানুষের আবেগকে যদি কাজে লাগাতেই হয়, তবে মানুষ স্বদেশী দ্রব্য কিনুক দেশের জিনিস, দেশের শ্রমিক, তথা মানুষকে ভালোবেসে, অন্য দেশের মানুষ বা জিনিসকে ঘৃণা করে নয় !

© Nitya Nanda, 2020 (সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *