আত্মনির্ভরতার সাতকাহন

বেশ কয়েক দশক পর আমাদের দেশ আবার আত্মনির্ভরতার কথা বলছে।  স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তৎকালীন প্রধান মন্ত্রীও শুনিয়েছিলেন আত্মনির্ভরতার কথা। তবে অর্থনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভরতার কথা অবশ্য তারও এক দশক আগে থেকেই বলা হচ্ছিলো এবং কিছুটা প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল।  তাতে বিজ্ঞানী থেকে রাজনৈতিক নেতা এবং শিল্পপতি থেকে বিশেষজ্ঞ সব সরকমের ব্যক্তিত্বই সামিল ছিলেন।  স্বাধীনতার পর নেহরু, আম্বেদকর থেকে শ্যামাপ্রসাদ রা তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শের তফাৎকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে এলেন দেশকে আত্মনির্ভর করতে।  তখন অবশ্য আত্মনির্ভর নয়, তার ইংরেজি প্রতিশব্দ, বা self-reliance শব্দটা ব্যবহার করা হত।  তাই কেউ হয়তো বলতেই পারেন যে এখন আমরা আত্মনির্ভরতা শব্দেও বেশি আত্মনির্ভর হয়েছি।  তবে হিন্দি ভাষার যে বর্তমান রূপ, সেটা পেতে যে ব্রিটিশদেরও একটা ভূমিকা ছিল সেটাই বা অস্বীকার করা যায় কি করে ?

তবে ভাষায় আত্মনির্ভরতার থেকে যেটা বেশি জরুরি সেটা হলে আমাদের আত্মনির্ভর হতে হবে আমাদের মননে।  এই যে আমাদের সামগ্রিক ভাবে যে অর্থনৈতিক চিন্তা বা আরও সাম্প্রতিক কালে আমরা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যে কৌশল অবলম্বন করছি তার মধ্যে কি মননে আত্মনির্ভরতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ? এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার মননে আত্মনির্ভরতার অর্থ কিন্তু এই নয় যে অন্যের কাজ বা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবো না।  কিন্তু সেটা যেন নকল নবিশি না হয়ে যায়।  তা ছাড়া যদি শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা দৃষ্টিটা প্রশস্ত করতে না পারি, তাহলেও কিন্তু আত্মনির্ভরতার অবনমন ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্য একটা বদভ্যাস আছে।  আমাদের ঔপনিবেশিক অতীত অনেকটাই ঠিক করে আমরা কথা থেকে শিক্ষা নিতে চাই।  তাই আমাদের ঘোষিত নীতি পূবে তাকাও থেকে পূবে কর হলেও, আমরা এখনও পশ্চিমে তাকাতেই অভ্যস্ত।  এমন কি পশ্চিমেও আমরা ব্রিটেন আর আমেরিকা ছাড়া যে আরও অনেক দেশ আছে সেটাও অনেক সময় ভুলে যাই।

আমরা আমাদের শিক্ষা, দীক্ষা আর ব্যবহারেই বা কতটা আত্মনির্ভর ? এব্যাপারে আমাদের আত্মবাচন নিয়েও আমাদের বদনাম আছে।  আমরা শুধু নিজের কথা বলতেই ব্যস্ত, অন্যের কথা শোনার বা বোঝার মতো মানসিকতা আমাদের নেই।  কিন্তু এই আত্মবাচনেই বা আমাদের কতটা আত্মনির্ভর ? আমরা যে নিজেদের কথা শোনাই, তার কতটা আমাদের নিজস্ব উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে, আর কতটাই বা অন্যের থেকে শোনা কথা দিয়েই চলে আমাদের আত্মবাচন ? বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য।  সামাজিক মাধ্যমে ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবর ছড়ানোর ব্যাপারে আমাদের দেশ নাকি এক নম্বরে।  কিছু লোক হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভয় খবর ছড়ায়।  তবে বেশিরভাগই ছড়ায় ভুয়ো খবর কেই সত্য বলে বিশ্বাস করে।  এই ভুয়ো খবর গুলোর বেশির ভাগই একটু মাথা খাটালেই বোঝা যায়, যে এগুলো সত্য নয়।  আবার এদের অনেক গুলোর সত্যতাই অতি সহজেই পরখ করা যায়। কিন্তু এব্যাপারেও আমাদের পরনির্ভরতা এতটাই বেশি যে আমরা সেসবের ধরে কাছেও যাই না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি শিক্ষার্থী দের আত্মনির্ভর হতে শেখায় ? কোটা ফেরত ছাত্রছাত্রীরা এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কোন কোন ছাত্র নিজের জেলার নামও বলতে পারছিল না।  তারা বাড়ি ছাড়ার পর জেলা ভাগ হয়ে তার বাড়িটা এখন কোথায় সেটাও সে জানে না। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন এতো ছাত্র ছাত্রী কোটা যাওয়ার দরকার পরে কেন ? এখানে তো কোন শিক্ষা দেওয়া হয় না।  দেওয়া শুধু প্রশিক্ষণ, কিভাবে আইআইটির ভর্তি পরীক্ষায় আরো বেশি নম্বর পাওয়া যায়। পৃথিবীর আর কোন দেশে কি এমন ব্যবস্থা আছে, যেখানে শুধুমাত্র ডিগ্রি স্তরে ভর্তি হওয়ার জন্য এক বা দু বছর ব্যয় করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য।  শেষ বিচারে তো এই সময়টা পুরোটাই খরচের খাতায় ! কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার হল এই ছাত্র ছাত্রীরা কোটাতে শুধু মাত্র ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়, ভর্তির পরে কি হবে তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকে না।  আইআইটির ক্লাসে যখন নিয়মিত পরীক্ষা হয় তখন তো তার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করার জন্য তো কেউ থাকে না ?    আইআইটির শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়, তাঁরা কোটা হয়ে আসা ছাত্র ছাত্রীদের কিভাবে দেখেন। যারা ভর্তি পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে দু বছর নষ্ট করে তাদের সম্পর্কে যে খুব ভালো ধারণা হবে না সেটাই স্বাভাবিক, তা সে যতই তারা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাক না কেন !

একই কথা বলা যায় যাঁরা আমাদের আমলাতন্ত্রে জায়গা করে নিয়ে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেন তাদের সম্পর্কে।  এনাদের মধ্যে অনেকেই অবশ্যই কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই এবং বেশি সময় নড়তো না করেই ঢুকে পড়তে পারেন।  কিন্তু অনেকেই আবার আত্মবিশ্বাস রাখতে না পেরে প্রশিক্ষণ সংস্থার দ্বারস্থ হন এবং অনেক কষ্ট সাধ্য প্রচেষ্টার পর ঢুকতে সক্ষম হন।  এখানেও ঢুকতে গেলেও যে জ্ঞানের পরিধিও অনেক বাড়তে হয় তা নয়, প্রশিক্ষণ টা হয়, কিভাবে পরীক্ষাতে বেশি নম্বর পাওয়া যাবে তার। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভেবেছিলেন, আমলাতন্ত্র ভারতের প্রশাসন ব্যবস্থাকে একটা ইস্পাতের কাঠামো দেবে, যাতে করে রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনিক ব্যবস্থার অপব্যবহার হতে দেবে না।  তার জন্য অবশ্যই দরকার ছিল আমলাতন্ত্রের আত্মনির্ভরতা।  আর বল্লভভাই প্যাটেলের কল্পনা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে সেটা তো আর আমাদের অজানা নয়।

স্কুল কলেজের শিক্ষাতেই বা আমরা কতটা আত্মনির্ভরতা শেখাই। অনেককাল আগে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বলতে শুনেছিলাম, আমার বাচনটাই যদি পরীক্ষার খাতায় ফিরিয়ে দাও, তাহলে ফেল করবে।  আরো বলতেন শুধু পড়লে হবে না, ভাবতেও হবে।  কিন্তু অনেক শিক্ষকতা তাঁদের আত্মবাচন ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতায় না দেখতে পেলে খুশি হতে পারেন না।  ছাত্ররাও তাই বেশি ভাবতেও  ভয় পায়।  আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও তাই পি এইচডি গবেষণাপত্রেও তাই কুম্ভীলকবৃত্তির ছড়াছড়ি। তাই পরাধীন ভারত জগদীশচন্দ্র বসু , সত্যেন্দ্রনাথ বসু , প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা বা সি ভি রমন দের মত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানিদের তৈরী করতে পারলেও, স্বাধীন ভারত সেটা পারে না।  আমরা নাকি পরিকাঠামো দিই না এমন অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। হয়তো সেটা অসত্যও নয়। কিন্তু এরকম সমস্যা কি স্বাধীনতার আগে ছিল না ? আসলে আমরা ছোটথেকেই তাদের মাথাতে ঢোকাতে থাকি তোমরা কোটা যাবে, আইআইটিতে পড়বে, আইআইএমএ পড়বে এসব।  এর ফলে তাদের কল্পনা শক্তির অপমৃত্যু ঘটে।  তারা হয়ে যায় কলুর বলদের মত।

আত্মনির্ভরতার অভাব মানুষকে স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে দেয়।  দেশের মানুষ যদি আত্মনির্ভর না হয় তবে দেশ আত্মনির্ভর হবে কিভাবে।  আর আত্মনির্ভরতার বাস্তুতন্ত্রের একটা অন্যতম অঙ্গ হল আত্মনির্ভরতা কে পুরস্কৃত হতে হবে। আমাদের সমাজব্যবস্থা যদি এমন হয়ে দাঁড়ায় যেখানে পরনির্ভর না হলে কোন কাজ হাসিল করা যাবে না, তাহলে মানুষ আত্মনির্ভর হওয়ার সাহসটাই বা পাবে কোথা  থেকে ? আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সেটা ভালোমন্দ যাই হোকে না কেন, সমাজের একটা বোরো অংশকে তো সামিল ই করে না।  এই যে এখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরছে, তারা হয়তো আবার শহরে ফিরবে কয়েকমাস পর. তবে হয়ত একই জায়গায় নাও হতে পারে।  তাদের ছেলেরা আত্মনির্ভর হবে কোন মন্ত্রে ?

গত দুই তিন দশকে আমাদের দেশের নীতিসমূহের কতটা চালিত হয়েছে আত্মনির্ভরতার ধারণা থেকে আর কতটাই বা হয়েছে পরনির্ভর ধারণা থেকে সেটাও একটু বোঝা দরকার।  স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ভুল-ঠিক যাই করি না কেন, আত্মনির্ভরতাই ছিল নীতি প্রণয়নের ভিত্তি আজ আমরা সেখান থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। এর জন্য শুধু রাজনৈতিক নেতা বা আমলাতন্ত্র বা বিশেষজ্ঞ দেড় দোষ দিয়ে লাভ।  আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি প্রশ্ন করতে না শেখায়, সবকিছু বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতে শেখায়, তাহলে আত্মনির্ভরতা একটা সুদূর স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।

© Nitya Nanda, 2020 (সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *