কিছুদিন আগেই উদযাপিত হয়ে গেলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস, এ বছরে যার মূল বিষয় ছিল বায়ু দূষণ প্রতিরোধ I ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এর থেকে বেশি উপযুক্ত বিষয় বোধ হয় হতে পারতো না I কারণ, বায়ু দূষণের নিরিখে বিশ্বের প্রথম দশটি শহরের মধ্যে সাতটিই ভারতে অবস্থিত I এখন প্রশ্ন ওঠে ভারতের এমন অবস্থা কেন হলো ? এটা কি হঠাৎ করে হয়েছে না অনেক দিন ধরে এই পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছিলো আর আমরা এটাকে গুরুত্ব দিই নি I এর থেকেও বড় প্রশ্ন হলো এটা পুরোপুরি মানুষের কার্যকলাপের ফল না এর পেছনে কিছু প্রাকৃতিক কারণ ও আছে I ভারতের সাতটি শহর বাদ দিলে আর যে তিনটি শহর প্রথম দশে আছে তার মধ্যে দুটি আবার হলো পাকিস্তানে এবং ভারতের সীমার বেশ কাছেই I এর থেকে ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক কারণের তত্ত্বটি আরো জোরালো হয়ে ওঠে I অবশ্য এমনও হতে পারে যে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি দেশ-ই এমন কিছু করে যাতে বায়ু দূষণ বেড়ে যায় I
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বায়ু দূষণের মাত্রার তুলনা করা হয় বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা (suspended particulate matter) বা সংক্ষেপে বস্তুকণা (particulate matter)বা পিএম ২.৫ অর্থাৎ ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়েও ছোট মাপের বস্তুকণার পরিমানের এর নিরিখে I এই কণাগুলি যত ছোট হবে, তারা তত বেশি আমাদের ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে এবং এমনকি অ্যালভিওলিরও (আমাদের ফুসফুসের ক্ষুদ্র বায়ুগুলি যা গ্যাসীয় বিনিময়ে সহায়তা করে) ক্ষতি করতে পারবে । তবে আমাদের দেশে কিছুকাল আগে অবধি বায়ু দূষণ মাপা হতো শুধুমাত্র পিএম ১০ এর নিরিখে I এখন অবশ্য পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০ দুটোই মাপা হয় I যাইহোক, সময়ের সাপেক্ষে বায়ু দূষণের বাড়াকমার তুলনামূলক বিচার করতে হলে করতে হবে পিএম ১০ এর নিরিখে I ১৯৯০ এবং ১৯৯৮ এর মধ্যে দিল্লিতে বাতাসে পিএম ১০ এর বার্ষিক গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘন মিটারে ৩৬৮ মাইক্রোগ্রাম I ২০০৭ এবং ২০১৫ এর মধ্যে সেটা কমে দাঁড়ায় ২২৫.৫৬ মাইক্রোগ্রাম I কাজেই সময়ের সাথে বায়ু দূষণের মাত্রা যে খুব বেড়েছে এটা জোর দিয়ে বলা মুশকিল I তবে বাতাসে পিএম ২.৫ এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না I
এখানে অবশ্য মনে রাখা দরকার যে পিএম ১০ এর গণনার মধ্যে পিএম ২.৫ ও ধরা থাকে I তবে মনোযোগ দেওয়ার বিষয় হল বাতাসে বস্তুকণা গঠন বা মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এদের দুই প্রকারে ভাগ করা হয় I প্রাথমিক বা যেগুলি বস্তুকণা হিসাবেই তৈরী হয় বা বাতাসে মেশে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত বা যেগুলি মূলত বায়বীয় অবস্থায় বাতাসে মেশে কিন্তু পরবর্তীকালে আলোক বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে বস্তুকনায় পরিণত হয় I স্বভাবিক কারণেই এই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত বস্তুকণাগুলি আয়তনে সূক্ষতর হয় এবং পিএম ২.৫ হিসাবেই পরিগণিত হয় I যদিও বাস্তবে এগুলো সাধারণত ০.১ মাইক্রোমিটার এর চেয়েও ছোট এবং স্বভাবতই অত্যন্ত ক্ষতিকর I
বায়ু দূষণের কারণ
আমাদের দেশে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার আধিক্যের সব থেকে বড় প্রাকৃতিক কারণ হল সারা বছর বৃষ্টি না হওয়া I বৃষ্টি হলে বাতাসের বস্তুকণাও ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় I কিন্তু এখানে লাগাতার বৃষ্টি হয় বছরে তিন থেকে চার মাস মাত্র I তাই বাকি সময় স্বভাবতই বাতাসে দূষণের প্রকোপ বেশি থাকে I এর পরেই উল্লেখ যোগ্য নির্ণায়ক হলো বায়ু প্রবাহের গতিপ্রকৃতি I এটা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা যে বায়ু দূষণের প্রকোপ সব থেকে বেশি থাকে শীত কালে যখন বৃষ্টি প্রায় হয় না আর বায়ু প্রবাহ থাকে নামমাত্র I জোরে হাওয়া চললে বাতাসের বস্তুকণাও উড়ে গিয়ে অনেকটাই সাফ হয়ে যায় I তবে এর একটা অন্য দিক ও আছে I হাওয়া চললে যেমন স্থানীয় ভাবে উদ্ভূত বস্তুকণা সরে যায় তেমনি আবার অন্য জায়গায় তৈরী হওয়া বস্তুকণাও এসে জড়ো হয় I তাই যেদিক থেকে বাতাস আসছে সেদিকের স্থানীয় ভাবে তৈরী দূষণের মাত্রা যদি বেশি হয় তবে হাওয়ার প্রভাবে কোনো স্থানের বায়ু দূষণ বেড়েও যেতে পারে I শীত কালে হাওয়া চলে কম তাই বেশির ভাগ জায়গাতেই বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হলো স্থানীয় ভাবে তৈরী হওয়া দূষণ I ভারতীয় উপমহাদেশের বায়ু দূষণের মানচিত্র দেখলে বোঝা যায়, বায়ু দূষণের প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে বেশি হলো সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতল এলাকায় I এর একটা অন্যতম কারণ হলো এই এলাকার পশ্চিম দিকে মরুভূমির অবস্থান এবং বায়ু প্রবাহের গতি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে I
আগেই বলা হয়েছে যে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার একটা বড় অংশই প্রকৃতিতেই থাকে এবং কোনোরকম রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন ছাড়াই বস্তুকণা হিসাবে বাতাসে ভাসমান হয়ে যায় I তবে এগুলোকে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে বা সূক্ষতর কণায় রূপান্তরিত করতে আমাদের অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা থাকে I বাড়ি বা রাস্তাঘাট নির্মাণে খোঁড়াখুঁড়ি বা সিমেন্ট ব্যবহারের সময় কিছুটা অংশ উড়ে যাওযা, রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে যানবাহন চলাচল, এমনকি রাস্তায় ঝাঁট দেওয়াতেও ভাসমান বস্তুকণার পরিমান বেড়ে যায় I এখনও গ্রামাঞ্চলে ঝাঁট দেওয়ার আগে মাটিতে জল ছিটিয়ে দেওয়ার প্রচলন আছে I কৃষি বা অন্যান্য কাজে অত্যধিক মাটির নিচের জল ব্যবহারের ফলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায় এবং জমি অনেক সময় উষর হয়ে যায় I ফলে জমিতে অবস্থিত ধুলিকণাকে বাতাসের উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও বেড়ে যায় I গরুর ধূলি উড়িয়ে বাড়ি ফেরা নিয়ে আমাদের রোমান্টিসিজম আছে তবে বায়ু দূষণ বাড়াতে এটিও কম যায় না I নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলাও দূষণ বাড়াতে সাহায্য করে কারণ গাছপালা কিছুটা হলেও এই বস্তুকণা গুলিকে শুষে নেয় এবং বাতাসে ছড়াতে বাধা দেয় I তবে বাতাসে দূষণের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে গাছের পাতার পত্ররন্ধ্র (stomata) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সালোকসংশ্লেষ (photosynthesis)প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় গাছপালারও ক্ষতি হতে পারে I তাই আমরা যখন রাস্তা করতে গিয়ে গাছ কেটে ফেলি তার ফল কি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য I
কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বা এই ধরণের জ্বালানি ব্যবহৃত হয় এমন কলকারখানা থেকে বিভিন্ন ধরণের গ্যাস ছাড়া বস্তুকণাও নির্গত হয় I তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের বস্তুকণা তৈরিতে গাড়ি বা কলকারখানা থেকে নিস্ক্রমিত গ্যাসের বড় ভূমিকা আছে I তবে এইসব গ্যাসকে বস্তুকনায় পরিবর্তিত করতে কার্যকরী ভূমিকা নেয় এমোনিয়া যেটা কিনা আবার কৃষিকার্যের দ্বারাও নিঃসরিত হয় I আমাদের দেশে কৃষিতে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় যার একটা বড় অংশই এমোনিয়া হয়ে বাতাসে মিশে যায় I উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সালফার ডাই অক্সাইড বা নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসে সালফিউরিক অ্যাসিড বা নাইট্রিক অ্যাসিড এ পরিণত হয় I এগুলি আবার এমোনিয়ার সংস্পর্শে এসে এমোনিয়াম সালফেট বা এমোনিয়াম নাইট্রেট এ পরিণত হয় যেগুলি কনার আকার নেয় I
এছাড়া অশোধিত তরল বর্জ্যও এমোনিয়া তৈরী করে I গত দুই দশকে বা তারও কিছুটা বেশি সময়ে কৃষিকার্যের যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষিজ বর্জ্য সংগ্রহন ও ব্যাবহারে কিছুটা সমস্যা তৈরী হয়েছে যার ফলে কৃষকরা এগুলিকে পুড়িয়ে দিচ্ছে I এটা দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে শুরু হলেও আস্তে আস্তে দেশের অন্যভাগে ছড়িয়ে পড়ছে I এছাড়া বিভিন্ন পুজো, দীপাবলী, বিবাহ আদি অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন খেলাধুলা উপলক্ষে প্রচুর পরিমানে বাজি পোড়ানো হচ্ছে যার দ্বারা প্রাথমিক এবং দ্বিতীয়পর্যায়ের দুই ধরণের বস্তুকণাই বাতাসে মিশছে I ক্রিকেট খেলায় ভারত জিতলে তো কথাই নাই I সারা দেশ বাজি পুড়িয়ে উৎসবে মেতে ওঠে I প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট ধূলিঝড়, আগ্নেয়গিরির উদগীরণ, দাবানল ইত্যাদি থেকেও বায়ু দূষণ হতে পারে I সমুদ্রের ধরে বায়ু দূষণ কম হয় বলেই আমরা জানি I কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে I আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক অনবরত সমুদ্রে জমা হচ্ছে এবং ভেঙে ভেঙে সুক্ষ কণায় পরিণত হচ্ছে I এই কণাগুলিও সামুদ্রিক বাষ্পের সাথে বাতাসে মিশে যাচ্ছে I
বায়ু দূষণের প্রভাব
ব্যাপক অর্থে বায়ু দূষণ বলতে শুধু মাত্র ভাসমান বস্তুকণা বোঝায় না I বাতাসে অতিরিক্ত সালফার ডাই অক্সাইড বা নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড থাকলে তা শ্বাস নালীতে ঢুকে গিয়ে আমাদের দেহে অবস্থিত জলের সংস্পর্শে এসে সালফিউরিক অ্যাসিড বা নাইট্রিক অ্যাসিড এ পরিণত হয় যা তীব্ৰ জ্বালা বা শ্বাস কষ্টের সৃষ্টি করে I চোখ জ্বালাও হতে পারে I এইরকমের দূষণ অ্যাসিড বৃষ্টি করে প্রকৃতির প্রভূত ক্ষতি করতে পারে I ভাসমান বস্তুকণার সালোকসংশ্লেষ ব্যাহত করার সম্ভাবনার কথা আগেই বলা হয়েছে I ভাসমান বস্তুকণার সবথেকে সাধারণ প্রভাব হলো শ্বাস নালীকে উত্তেজিত করে সর্দি কাশির সৃষ্টি করা I অপেক্ষাকৃত বড় কণাগুলি হাঁচির সাথে বেরিয়ে যায় I তবে সূক্ষতর কণাগুলি আর ও ভেতরে চলে যায় এবং আমাদের দেহ সেটাকে সংক্রমণ বলে ধরে নেয় I যার ফলে প্রদাহ এবং শ্বাসকষ্ট হয় I যাদের এমনিতেই হাঁপানির ধাত আছে তাদের সমস্যা আরো বেড়ে যায় যা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে I শ্বাসনালী বা ফুসফুসের প্রদাহ অন্য জায়গায় ছড়িয়ে গিয়ে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হওয়াও অসম্ভব নয় I শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটা আরো ক্ষতিকর I শিশুদের ফুসফুসের ক্ষতি এবং এর কার্যকারিতা স্থায়ীভাবে কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না I গর্ভবতী মহিলাদের কাশি এবং প্রদাহ গর্ভপাতের ও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে I
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ লোক মারা যায় বায়ুদূষণ জনিত কারণে I হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস এর রোগ জনিত মৃত্যুর বা ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল বায়ুদূষণ I ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৭ তে ভারতে যতলোক মারা গিয়েছিল তার প্রায় ১২.৫ শতাংশ বা প্রায় ১২ লক্ষ লোকের মৃত্যুর সাথে সাথে কোনো না কোনো ভাবে বায়ুদূষণের যোগ ছিল I আর যারা বায়ুদূষণ জনিত কারণে মারা গিয়েছিল তাদের অর্ধেকেরও বেশি লোকের বয়স ছিল ৭০ বছরের নীচে I আমাদের দেশের সরকার অবশ্য এই অধ্যয়নটিকে মানতে চায় নি I আরো একটি হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে গড়ে প্রায় ৪ শতাংশ জাতীয় উৎপাদন নষ্ট হয় বায়ুদূষণ জনিত কারণে I
বায়ু দূষণের প্রতিকার
দিল্লি বা তার আশেপাশের এলাকার বায়ুদূষণ নিয়ে বেশ কয়েকটি অধ্যয়ন হলেও কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে বায়ুদূষণ নিয়ে সেরকম কিছু হয়নি I তাই এখানকার বায়ুদূষণ এর প্রকৃতি ও উৎস নিয়ে সম্যক ধারণাও নেই I তবে দিল্লি কেন্দ্রিক অধ্যয়ন গুলি এবং পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশেপাশের এলাকার প্রকৃতিগত পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তিতে অনেকটাই অনুমান করা যায় I তবে এটা আর আমাদের কাছে অজানা নেই যে শুধুমাত্র কলকাতাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের অনেক শহরেই, এমনকি বহরমপুর এর মতো ছোট শহরে যেখানে শিল্প কারখানা কিছুই নেই তেমন জায়গাতেও অনেক সময় বায়ুদূষণের মাত্রা বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় I ছোট শহর বা গ্রামাঞ্চলে এরকম দূষণের স্থানীয় উৎস হলো রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষনের অভাব এবং তার উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল I এইসব জায়গায় যখন ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায় তখন সমস্যাটা আরো প্রকট হয় I যানবাহনের ধোঁয়া এবং কৃষিকার্য থেকে উৎসরিত এমোনিয়া মিলেমিশে বায়ুদূষণের মাত্রা আরো বেড়ে যায় I তাই রাস্তাঘাটের রক্ষনাবেক্ষন আরো উন্নত করতে হবে তার সাথে এটাও দেখতে যাতে যানবাহন গুলোর রক্ষনাবেক্ষনও ঠিকঠাক হয় I রাস্তায় যাতে ট্রাফিক জ্যাম না হয় তার জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে I এরজন্য দরকার হবে ট্রাফিক নিয়মের ঠিকমতো প্রতিপালন I এর একটা অন্যতম দিক হলো মালবাহী গাড়িতে যাতে যথাবিহিত সীমার অধিক পরিমানে মালবহন না হয় I
তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল এবং তার ও পশ্চিমের এলাকায় অনেকগুলি কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যেগুলোর অবদান পশ্চিমবঙ্গের বায়ুদূষনে অনেকটাই I শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমভাগ এবং ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় রয়েছে অনেক কয়লা খনি I এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে এবং কয়লাখনি গুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ যথাযথ ভাবে করা হয় না I এছাড়াও রয়েছে অনেক কলকারখানা যেখানে জ্বালানি হিসাবে কয়লা ব্যবহার করা হয় I এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলো স্পঞ্জ আয়রন কারখানা যাতে অত্যধিক মাত্রায় দূষণ ছড়ায় I এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ইঁটভাটা যেগুলি থেকেও অনেক দূষণ ছড়ায় I কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে এইসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ তদারকির জন্যে যে ধরণের পরিকাঠামো দরকার তার সিকিভাগ ও উপস্থিত নেই I তাই যথাযোগ্য পরিকাঠামো তৈরির কোনো বিকল্প নেই I তবে সারা রাজ্য জুড়ে দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হবে গ্রাম শহর পথঘাট যতটা সম্ভব সবুজে ঢেকে দেওয়া I এর একটি আনুষঙ্গিক বিষয় হল যথাযত জল সংরক্ষণ I কারণ জলাভূমি না থাকলে বা মাটিতে আর্দ্রতা না থাকলে সবুজের অভিযান সম্ভব নয় I
কলকাতা শহর বা তার আশেপাশে কিছু কলকারখানা আছে যেগুলি থেকে দূষণ ছড়ায় I তবে এখানে একটা বড় সমস্যা হলো এখানে অনেক পুরনো গাড়ী বা বাস বা ট্রাক চলে যেটা অন্য বড় শহরের তুলনায় অনেক বেশি I স্বভাবতই এখানকার গাড়ী গুলির রক্ষনাবেক্ষন ও অন্য বড় শহরের তুলনায় অনেক খারাপ I তাই এখানেও এইসব নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে I এছাড়া কলকাতায় অনেক ত্রিচক্রযান চলে কাটা তেল বলে প্রচলিত একধরণের মিশ্রনে যা তৈরী হয় কেরোসিন এর সাথে লুব্রিক্যান্ট বা অন্যকিছু মিশিয়ে যেটা মারাত্মক রকমের দূষণ সৃষ্টি করে I এটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার I গৃহ, রাস্তাঘাট বা ফ্লাইওভার নির্মাণ এর সময় খনন কার্য বা সিমেন্ট এর ব্যবহার ও অনেক দূষণ ছড়ায় I তবে যথাযত ব্যবস্থা নিলে এসব থেকে দূষণ অনেকটাই কমিয়ে ফেলা সম্ভব I কলকাতা শহরে অনেকগুলো মেট্রো প্রকল্পের কাজ চলছে I কিন্তু কাজ চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে I এগুলির কাজ দ্রুত শেষ করতে পারলে যেমন একদিকে নির্মাণজনিত দূষণ বন্ধ করা যাবে, অন্যদিকে গাড়ির ব্যবহার ও কমানো যাবে যাতে দূষণ কে কিছুটা হলেও কাবু করা যাবে I
সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গেও কৃষিকার্যের যান্ত্রিকীকরন বেড়েছে ফলে কৃষিজ বর্জ্য পুড়িয়ে দেওয়ার কুঅভ্যাস যেটা দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে প্রচলিত ছিল সেটা আস্তে আস্তে পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়েছে I এটিকে অংকুরেই বিনষ্ট করার কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার I দূর্গাপুজো কালীপুজো বা অন্যান্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাজি পোড়ানোর পরিমান মাঝে কয়েকবছর একটু কমলেও, সাম্প্রতিক কালে আবার বেড়েছে I তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বাজি পোড়ানোর উপর নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছিল শব্দদূষণের পরিপ্রেক্ষিতে I যার ফলে বায়ুদূষণের ব্যাপারটা গুরুত্বই পায় নি I এখন বাজারে অনেক রকমের বাজি এসেছে যাতে শব্দ কম উৎপন্ন হলেও বায়ুদূষণ হয় অনেক I এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরী I এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে পশ্চিমবঙ্গের ই প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে বাজি পোড়ানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ I সিকিমের মতো একটি রাজ্য যেখানে অন্যান্য কারণে দূষণ প্রায় নেই বললেই চলে সেখানে সরকার এরকম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারলে অন্যান্য রাজ্যে এটাকে কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ না করার কোনো সুযুক্তি থাকতে পারে না I
এইসব পদক্ষেপ দিয়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বায়ুদূষণ অনেকটাই কমানো সম্ভব I তবে এখানে বায়ুদূষণের প্রকৃতি, উৎস তথা কারণ নিয়ে নির্ভরযোগ্য অধ্যয়ন হওয়াও দরকার I
© Nitya Nanda, 2019 (সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত)