একটা কথা আছে, বিপর্যয় কখনো এক আসে না। না, করোনার পরপরই এল ঘূর্ণিঝড় আমপান, সেকথা এখানে বলা হচ্ছে না। করোনার সাথে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এসেছে, সেটাও মোটামুটি সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু করোনার সাথে সাথে এসেছে সামাজিক বিভেদ জনিত বিপর্যয়ও । সারা দেশ জুড়ে ডাক্তার এবং সেবিকা রা কি ধরণের ঘৃণা এবং বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন বা এখনো হয়ে চলেছেন সেটা আমরা সবাই দেখছি। কোথাও বাড়ির মালিক তাঁদের জিনিসপত্র সমেত রাস্তায় বের করে দিয়েছে, তো কোথাও তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে, তো কোথাও আবার হতে হয়েছে শারীরিক নিগ্রহের শিকার। যে বাংলায় আমরা সুস্থ ও মানবিক সংস্কৃতির গর্ব করি, সেখানেও মনিপুরী সেবিকারা কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অবমাননাকর এবং অমানবিক ব্যবহারের শিকার হয়ে।
উত্তর পূর্ব ভারতের সব ধরণের লোকদেরই অবশ্য আলাদা করে দুর্ব্যবহার তথা নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। আমাদের দেশের একটা বড় অংশের মানুষের শিক্ষার এতই অভাব যে তাঁরা এই অঞ্চলের লোকেদের চীনা মানুষের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। করোনার উৎপত্তি যেহেতু চিনে, তাই অনেক জায়গাতেই উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষকে চীনা ভাবছেন এবং করোনার বাহক বলে ধরে নিচ্ছেন। স্বভাবতই অনেক সময় তাঁদের উপর নেমে আসছে নিগ্রহ।
করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের সাথেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অমানবিক ব্যবহারের খবর আসছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে চূড়ান্ত অমানবিক ব্যবহার করছে। আমরা অনেকেই এই সমস্ত ব্যবহার বা ঘটনার নিন্দা করছি বটে, তবে যাঁরা এই ধরণের ব্যবহার করছেন তাদের কে কি সত্যিই খুব দোষ দেওয়া যায় ? এই ধরণের ব্যবহার করার জন্য আমরা কি তাদের উৎসাহিত বা বাধ্য করিনি ?
সরকার থেকে শুরু করে, গণমাধ্যম তথা সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত আমাদের ভয় দেখান হচ্ছে। বার বার বলা হচ্ছে, ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন। এমন একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যেন রাস্তায় করোনা ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তায় বেরোলেই খপ করে ধরবে। রাস্তায় বেরোলেই যদি খপ করে ধরে, তাহলে যদি কেউ দেখে পাশের বাড়িতে কেউ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে তখন কি প্রতিবেশীরা গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বলবে যে চিন্তা কোরোনা, আমরা তো আছি ?
আসলে আমরা মানুষকে ভালো করে বুঝিয়ে, তাঁদের সচেতন করে বা তাঁদের উপর ভরসা রেখে নয়, ভয় দেখিয়ে করোনা জয় করতে চেয়েছি। আসলে আমাদের সরকারের খোলনলচে তৈরী করে দিয়েছিলো ব্রিটিশ রা। সময়ের সাথে হয়তো অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু মূল ব্যাপার, বা পথনির্দেশক নীতি (guiding principle) টা আসলে একই রয়ে গেছে। সেটা হলো নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা। সেবা করার মানসিকতা কিছুটা এলেও, এখনও অনেক কম। আর একটা ব্যাপার চিরন্তন, সেটা হলো, স্থান-কাল নির্বিশেষে, শাসকের ভয় দেখিয়ে শাসন করার একটা প্রবণতা থাকে।
আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৮০০০ লোক মারা যায়। আমরা কি হিসেব রেখেছি তাদের শরীরে কি কি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস বাসা বেঁধেছিলো ? হিসাব নিলে দেখতে পেতাম করোনার থেকে আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর জীবাণু আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া গত কয়েকদিনে অনেক লোক অন্য অনেক অসুখে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। ডাক্তারের চেম্বার এবং প্রাইভেট হাসপাতাল বেশির ভাগই বন্ধ। যেগুলো খোলা সেখানেও ভর্তি করানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া অনেকে তো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারছে না, কারণ পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ।
সারা পৃথিবী জুড়ে করোনা আক্রান্তদের অনেকে কিন্তু মারা গেছে হার্ট আটকে, যাদের অনেকেরই আগে থেকে কোনো হার্টের অসুবিধা ছিল না। এমন তো নয় এরা মারা গেছে স্রেফ ভয়ের কারণে হার্ট আটকে ? এটা তো এখন অনেকেই বলছেন যে, ভাইরাসটা অবিশ্বাস্য রকমের ছোঁয়াচে, কিন্তু সেই হিসাবে ঘাতক নয়। বেশিরভাগ লোকে তো বুঝতেই পারছে না যে ভাইরাসটা তাদের শরীরেও বাসা বেঁধেছে ! তিন মাসে আমাদের দেশে মারা গেলেন প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ, আর করোনা ভাইরাস সহ মারা গেলেন প্রায় তিন হাজার লোক। অবশ্যই এদের সবাই যে করোনা সংক্রমণের কারণেই মারা গেছেন একথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। কারণ এদের প্রায় সকলেরই অন্য কিছু না কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল যে কারণে মৃত্যু হতেই পারত। এই ব্যাপারটা প্রথম সরকারি ভাবে স্বীকৃত হয় পশ্চিমবঙ্গে। তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক কম হয় নি। এখন ভারত সরকার থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাই এটা মানছে। এই ব্যাপারটা যদি সব জায়গায় সব স্তরে অনেক আগেই স্বীকৃতি পেত, তাহলে হয়তো মানুষের মধ্যে ভয় একটু কম তৈরী হত। বাড়তো না মানুষের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস এবং অমানবিক ব্যবহার।
কঠোর ভাবে তালাবন্দি করার ঘোষণাও মানুষ কে কম ভীত করে নি। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য তো মানুষকে বেরোতে হবে। সেখানেও আমরা অনেক দোকান বন্ধ করে দিলাম এবং অনেক দোকানের খোলার সময় কমিয়ে দিলাম। আমাদের সবাইকে অনেক কম সময়ের মধ্যে সবকিছু কেনাকাটা করতে বাধ্য করা হল। অর্থাৎ আমরা দোকানে গিয়ে হুড়োহুড়ি করলাম, ভিড় বাড়িয়ে দিলাম। তাতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়লো বই কমল না। আমাদের ভয় এবং উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। একমাস বন্ধ রাখার পর মদের দোকান খোলা হল। ট্যাক্স বড় বালাই। তাহলে সারাদিন খুলে রাখতে আপত্তি কিসের ? না, খোলা থাকবে দু ঘন্টা, বা চার ঘন্টা। সবাই পড়িমরি করে ছুটলো ওই কম সময়ের মধ্যে নিজের বোতলটা হাতিয়ে নিতে, ফলত লম্বা লাইন আর হুড়োহুড়ি ! আরও ভয়।
করোনা কোন ঝড়ের নাম নয়। ঝড়ের সময় ঘরে ঢুকে গেলাম আর ঝড় থেমে গেলেই ভাঙা বাড়িঘর সারিয়ে নিলাম আর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলো এমন নয়। করোনা কয়েকদিনের জন্য আমাদের মাঝে বেড়াতে আসে নি। করোনা এখন থাকবে কয়েক মাস, বা কয়েক বছর বা তারও বেশি। আমাদের এখন ভাবতে হবে করোনা কে সাথে নিয়ে কিকরে ঘর করবো। ঠিক যেমন আরও অনেক ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস এর সাথে সহাবস্থান করছি। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন এরকমই বলছে। কিন্তু এতটা ভয় পাওয়ার পরে কি করোনাকে নিয়ে ঘর করা এতো সহজ হবে ?
ভয়ের আবহ তৈরী করার সাথে সাথে আমদানি করলাম সামাজিক দূরীকরণ (social distancing ) এর মত শব্দবন্ধ। সামাজিক দূরত্ব সমাজতত্বের একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা। এর মানে মানুষ পূর্বধারণা, কুসংকার বা অমূলক ভয়ের বশবর্তী হয়ে অন্য গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি বা ধর্মের লোকেদের থেকে দূরে থাকতে চায়। ঠিকমতো জানার বা বোঝারও চেষ্টা করে না। আর এই আবহেই সামাজিক মাধ্যমে প্রচলিত হতে থাকল আমাদের অশৌচ, অস্পৃশ্যতা, জাতিগত বিভেদ সম্পর্কে তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক ভিত্তি”থাকার দাবী। সামাজিক দূরত্ব আরো বেড়ে গেল। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং বিদ্বেষ আরও বাড়লো। অথচ আমরা তো চেয়েছিলাম মানুষ নিজেদের মধ্যে শুধুমাত্র একটু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুক। সামাজিক ভাবে মানুষ একে অন্যের থেকে দূরে সরে না গিয়ে এই লড়াইয়ে সকলে সকলের পাশে থাকুক, এটাই তো আমাদের প্রয়োজন ছিল !
এটা এখন পরিষ্কার যে ভাইরাস টা বেশকিছুদিন আমাদের মধ্যে বিরাজমান থাকবে, যতদিন না কোন প্রতিষেধক বা প্রকৃত ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিক ছন্দে না হলেও, ছন্দ পাল্টেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই হবে। কিন্তু এই ভয় আর অবিশ্বাসের আবহে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা কি খুব সহজ হবে ? কিন্তু তার থেকেও যেটা বড় উদ্বেগের বিষয় হল, ভয় হয়তো একদিন কেটে যাবে, অর্থনৈতিক স্থিতিও হয়তো ফিরবে, কিন্তু মানুষে মানুষে যে সামাজিক দূরত্ব তৈরী হল, যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরী হল সেটা হয়তো সহজে যাবে না।
© Nitya Nanda, 2020 (সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত)